তেলের লরি উল্টে আগুন তিনজন নিহত, দগ্ধ ৭

ট্রাকভর্তি তরমুজ নিয়ে বরগুনা থেকে ঢাকায় আসবেন কৃষক আল আমিন। তখন তাঁর ১০ বছরের মেয়ে মীম বায়না ধরে, সেও আসবে বাবার সঙ্গে। সাভারে মামার বাড়িতে বেড়াতে যাবে সে। মেয়ের আবদার ফেলতে পারেননি বাবা। তাই মেয়েকেও ট্রাকে তুলে নেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে তাদের ট্রাকটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভারের হেমায়েতপুরের জোড়পুল এলাকা পার হচ্ছিল। এ সময় সেখানে একটি তেলের লরি উল্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে শিশু মীম, তার বাবাসহ আশপাশের কয়েকটি যানবাহনের অন্তত ১০ জন দগ্ধ হন। দগ্ধদের মধ্যে সিমেন্টবাহী ট্রাকের হেলপার ইকবাল হোসেন (৩৫) ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আড়তদার নজরুল ইসলাম (৪৫)। পরে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তরমুজবাহী ট্রাকের চালক হেলাল হাওলাদারের (১৮) মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনায় দগ্ধ সাতজন এখন ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে তরমুজবাহী ট্রাকটির হেলপার সাকিব হোসেনের (১৫) শরীর শতভাগ পুড়ে যাওয়ায় তার অবস্থা সংকটাপন্ন। এ ছাড়া সিমেন্টবাহী ট্রাকের শ্রমিক মিলন মোল্লার শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনিও ঝুঁকিমুক্ত নন। দগ্ধদের স্বজনরা বলছেন, জীবিকার তাগিদে তাদের প্রিয়জন বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটছিলেন। তেলের লরি উল্টে যাওয়া ছিল পৃথক দুর্ঘটনা। কিন্তু সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া তেল তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছে।
দগ্ধ অপর তিনজন হলেন একেএইচ গ্রুপের গাড়িচালক আবদুস সালাম, প্রিমিয়ার সিমেন্ট কোম্পানির গাড়িচালক মো. আলামিন ও তরমুজের ট্রাকে থাকা কৃষক নিরঞ্জন রায়।
গতকাল বার্ন ইনস্টিটিউটের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) সামনে গিয়ে দেখা যায় গুরুতর দগ্ধদের স্বজনের ভিড়। কেউ কেউ উচ্চ স্বরে কাঁদছেন। তাদের মধ্যে হেলালের মামাতো বোন সুইটি বেগম সমকালকে জানান, বরগুনা সদরের ছোট গৌরীচন্না এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন হেলাল। তাঁর বাবা জয়নুদ্দিন হাওলাদার অনেক আগেই মারা গেছেন। মা আলেয়া বেগম ভিক্ষা করে একমাত্র সন্তানকে বড় করে তুলেছেন। অভাবের সংসারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই পরিবহন খাতে যুক্ত হন হেলাল। এরই মধ্যে তিনি ট্রাকচালক হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় মালপত্র বহন শুরু করেন।
তিনি আরও জানান, হেলাল প্রতিদিন ট্রাকে তরমুজ বহন করছেন বলে দু’দিন আগে তাঁর কাছে তরমুজ খেতে চান। সোমবার রাতে বোনকে ডেকে একটি তরমুজ হাতে তুলে দেন হেলাল। এরপর ভোরে একজন ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানান। রাতে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। দুঃসংবাদ শুনে তাঁর মা পাগলপ্রায়। তিন বছর আগে বিয়ে করেন হেলাল। তাঁর স্ত্রী সোনিয়া বেগম তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
ট্রাকটির হেলপার সাকিবের অবস্থাও সংকটাপন্ন। সাকিবের বড় ভাই নির্মাণ শ্রমিক নাঈম হোসেন বলেন, চার মাস আগে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে সাকিব। তাদের বাবা মোহাম্মদ আলী খাগড়াছড়িতে অটোরিকশা চালান। তাদের বাড়ি গৌরিচন্না বাজার এলাকায়।
দগ্ধ মিলন মোল্লার বাবা ফরিদ মোল্লা জানান, তাঁর ছেলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। ঘটনার সময় তিনি সিমেন্ট বহনকারী ট্রাকটিতে ছিলেন। তিনি সাভারের হেমায়েতপুরে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। আগুনে শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তাঁর অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
এদিকে সিমেন্টবাহী ট্রাকটির হেলপার ছিলেন দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ইকবাল হোসেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি যশোরের চৌগাছায়।
দগ্ধ আল আমিনের চাচা শহীদ তালুকদার জানান, তাদের বাড়ি বরগুনা সদরে। তাঁর ভাতিজা কৃষিকাজ করেন। এবার ঋণ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন। গাজীপুরের চৌরাস্তা এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম তাঁরসহ অন্য কৃষকের তরমুজ কিনে ট্রাকবোঝাই করে ফিরছিলেন। সেই ট্রাকে তরমুজের ওপর বসে আসছিলেন আল আমিন ও নিরঞ্জন রায়। আর ট্রাকচালকের পাশে ছিলেন নজরুল ও আল আমিনের মেয়ে মীম। ছোট্ট মেয়েটির শ্বাসনালিসহ শরীরের ২০ শতাংশ আগুনে পুড়েছে।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া তেলবাহী একটি লরি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোড়পুল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পরে সেটি সড়কে ইউটার্ন নির্মাণের জন্য রাখা কংক্রিটের ব্লকে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়। এরপর তেল ছড়িয়ে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়। মুহূর্তে ওই সড়কে থাকা একটি তরমুজবোঝাই ট্রাক, একটি সিমেন্টবাহী ট্রাক, একটি কাভার্ডভ্যান ও একটি প্রাইভেটকারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওই যানবাহনগুলোর চালক-যাত্রীরা দগ্ধ হন। এ ঘটনায় সড়কে দুই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের।
প্রত্যক্ষদর্শী গাড়ির মেকানিক সুমন মিয়া বলেন, সেহরি খেয়ে জোড়পুল এলাকার বাসা থেকে হেমায়েতপুরে গ্যারেজে যাচ্ছিলাম। সড়কে উঠতেই বিকট আওয়াজ শুনতে পাই। পরে দেখতে পাই, তেলবাহী একটি লরি সড়কে উল্টে আছে। সেটিসহ আশপাশের কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরে গেছে। আমরা কয়েকজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাই। পরে স্থানীয় লোকজন ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে তারা এসে আগুন নেভায়।
দগ্ধ গাড়িচালক আবদুস সালাম বলেন, জোড়পুলের একটি রিফুয়েলিং স্টেশন থেকে গ্যাস নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলাম। তখন একটি তেলবাহী লরি উল্টে পুরো এলাকায় তেল ছড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সেখানে আগুন ধরে যায়। আমার প্রাইভেটকারেও আগুন লেগে যায়। আমি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে আসি।
ঘটনাস্থলে দেখা যায়, জোড়পুল এলাকায় মহাসড়কে তেল পড়ে আছে। সকালেও সড়কের উভয় পাশে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। ঢাকামুখী লেনে সাভার ব্যাংকটাউন ব্রিজ থেকে জোড়পুল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার ও আরিচামুখী লেনে জোড়পুল থেকে বলিয়ারপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটারের বেশি যানজট ছিল।
সাভার হাইওয়ে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাবুল হোসেন বলেন, এ ঘটনায় তেলের লরির চালক, হেলপার ও মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হবে।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: